স্মরণ : জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ।
২৪ জানুয়ারী, ২০১৫ ইং
২৪ জানুয়ারী, ২০১৫ ইং
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
নূরুল ইসলাম স্যার মহাপ্রয়াণে, না ফেরার দেশে চলে গেছেন আজ থেকে ২ বছর আগে, ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ সালে। আজও তাকে এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ও তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। স্যার ছিলেন এক প্রবল কর্মযজ্ঞের কান্ডারী, তিনি সারাজীবন যে কাজেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজের মেধা, শ্রম আর ভালবাসা দিয়ে তিনি আমাদের চিরঋণী করে রেখে গেছেন।
একজন চিকিত্সক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। শুধু রোগের উপশমই নয়, তিনি রোগ ও রোগী নিয়ে চিন্তা করতেন, ছিলেন চিকিত্সা বিজ্ঞানী। তার অসংখ্য গবেষণাপত্র দেশে ও বিদেশের খ্যাতিমান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সমাজের সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতন করতে তিনি ছিলেন তত্পর। এদেশে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে তিনিই প্রথম ধূমপান বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেন এবং “আমরা ধূমপান নিবারণ করি” বা “আধুনিক” এর প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ওষুধের অপ্রয়োজনীয় এবং অপব্যবহার রোধকল্পে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের অন্যতম ছিলেন। তিনি নিজে নেহায়েত যে সমস্ত ওষুধ প্রয়োজনীয় সেগুলোই রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশনে লিখতেন, অযথা অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ওষুধ পরিহার করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অনেক সময় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছিল তার একদম অপছন্দ। প্রায়ই তাকে বলতে শুনেছি, রোগীর কাছ থেকে সুন্দর করে রোগের ইতিহাস নিয়ে এবং রোগীকে ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই অনেক রোগ সনাক্ত করা সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর বিশাল অর্থের অপচয় ঘটে, যা অনেকেই বহন করতে অক্ষম।
শুধু চিকিত্সক হিসেবেই নয়, চিকিত্সা বিজ্ঞানের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের মাঝে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বর্তমানে আমাদের দেশে যারা মেধাবি এবং দক্ষ চিকিত্সক হিসেবে চিকিত্সার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাল শিক্ষক হিসেবেও শিক্ষাসেবা দিয়ে চলছেন, তাদের শিক্ষাগুরু হিসেবে স্যারের অবদান অপরিসীম। ব্যক্তিজীবনে স্যার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতেন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সত্য ভাষণে অকপট, সততা আর সত্যের পথে অবিচল এই মানুষটি সবসময়ই ছিলেন আন্তরিক, মমতাপূর্ণ ও স্নেহাদ্র।
একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে ইসলাম স্যার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির, অন্তত বাহ্যিকভাবে তাই মনে হতো। কাজের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা তিনি সহ্য করতেন না। নিজে নিয়মের অনুশাসন মেনে চলতেন, অন্যদেরও নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতেন। এ ক্ষেত্রে কোনো বিচ্যুতি হলে তিনি কঠোর শাসন করতেন, এমনকি অনেক সময় গালমন্দও করতেন। কিন্তু এ সবই ছিল শুধু সঠিক কাজটা আদায় করার জন্যই। যাকে বকাঝকা করতেন, দেখা যেত পর মুহূর্তে তাকেই আবার সস্নেহে আলিঙ্গন করছেন। তিনি শুধু ছড়ি হাতে শাসক ছিলেন না, পিতৃসম মমতাকারীও ছিলেন। প্রায়ই তিনি বলতেন,“শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করেন যিনি”।
নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম স্যার ছিলেন চৌকষ। নিজের বিচক্ষণতার উপর তার আত্মশক্তি ও আত্মপ্রত্যয় ছিল অত্যন্ত প্রবল আর আস্থা ছিল অবিচল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক বিশিষ্ট বাণী স্যার মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার এক ডায়েরিতে ঐ বাণীটি লেখা ছিল—“বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেওনা তাহার কাছে। নড়াচড়া করে, তবুও সে মরা, জ্যান্ত সে মরিয়াছে। শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ঈমান লয়েছে কেড়ে, পরাণ গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে, ভয়ে তার দেহ ছেড়ে।”
স্যার কাজ করতেন নিজের পদ্ধতিতে, শাসন করতেন কঠোর হস্তে। নিপুণ হাতে তিনি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, এতে কাজের গতি বাড়ত, সমন্বয় ঠিক থাকত। এক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য অনেকেই তাকে স্বৈরশাসক বা ডিক্টেটর হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন বেনেভলেন্ট ডিক্টেটর। আর এ জন্যই তিনি তত্কালীন পিজি হাসপাতালের মত একটি প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা বর্তমানে দেশের একমাত্র চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। সকল আমলাতন্ত্র, রাজনীতি আর দুর্নীতিকে পায়ে দলে নিজ হাতে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে পেরেছিলেন।
শুধু তাই নয়, সারাজীবন তিনি আরো অসংখ্য সংস্থা আর প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি) প্রতিষ্ঠা তার কর্মযজ্ঞের অন্যতম বিশিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেন।
শেষ জীবনে ইসলাম স্যার বহুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু সেই অবস্থায়ও তিনি কাজ করে গেছেন, নিত্য নতুন সৃষ্টি করেছেন, দক্ষ হাতে প্রশাসন চালিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন যে, আল্লাহর রহমতে আর মানুষের দোয়ায় বেঁচে আছি, হয়তো আমার কাজ শেষ হয়নি বলেই।
তিনি এক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। তার অনন্য সাধারণ কীর্তি, কর্মযজ্ঞ আর অমোঘ ব্যক্তিত্বের স্মৃতি ডাক্তার সমাজসহ সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে অবশ্যই স্মরণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তার কর্মস্পৃহা বুকে নিয়ে, মাটি ও মানুষের সেবার মানসিকতা ধারণ করে যদি আমরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারি, তবে তাই হবে এই মহান ব্যক্তির প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন।
লেখক :ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment